শনিবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:১২ অপরাহ্ন
এম আর ইসলাম:
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নেতৃত্বের ঘাটতি কখনো হয়নি। কারণ, এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। নেতার অনুপস্থিতিতে রাজনৈতিক দল বা রাষ্ট্র কখনো থেমে থাকে না। যোগ্যতা বা জনপ্রিয়তা এক জিনিস নয়। তবে, যোগ্যদেরই জনপ্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। একটা রাজনৈতিক দলে সাধারণত, দুই ধরনের রাজনীতিবিদ থাকেন। এদের কেউ কেউ থাকেন, যারা শুধু দলের মধ্যেই স্বীকৃত থাকেন; অন্যদিকে কিছু রাজনীতিবিদ থাকেন যারা দলীয় গণ্ডি অতিক্রম করেন, হয়ে যান জাতীয় নেতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ইতিহাস দেখলে, যেসব জাতীয় নেতার নাম পাওয়া যায়, যেমন: বঙ্গবন্ধু, ভাসানী, তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামারুজ্জামান প্রমুখ দলীয় নেতা থেকে জাতীয় নেতা হয়েছিলেন। নিজেদের এমন অবস্থানে নিতে, তাদের যে ত্যাগ, চেষ্টা, দেশপ্রেম ছিল, তা এ জাতির জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।
মুসলিম লীগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দল হিসেবে যে রাজনৈতিক সমর্থন পেয়েছিল, তার কারণ ছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ পেয়েছিল একঝাঁক তরুণ, দেশপ্রেমিক রাজনীতিক। যারা দেশের জন্য নিজেদের লেখাপড়া, ক্যারিয়ার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি, পরিবার, ব্যক্তিজীবন, সব ত্যাগ করেছিলেন। তখনকার নেতাদের দলীয় আদর্শ আর দেশীয় স্বার্থ মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। তাই, তখন আওয়ামী লীগের নেতাদের এদেশের মানুষ বিশ্বাস করেছিল সর্বাগ্রে। যার প্রমাণ স্বরূপ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে, এই নেতারা নিরঙ্কুশ সমর্থন পেয়েছিলেন। তারা হয়ে উঠেছিলেন গণমানুষের নেতা।
গত ত্রিশ বছরে রাজনীতি অনেক কিছু হারিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, যোগ্য নেতৃত্বের অভাব। এই সময়ে হাতেগোনা কয়েকজন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ছাড়া আওয়ামী লীগে দলমত নির্বিশেষে আস্থাভাজন রাজনীতিবিদ তেমন একটা দেখা যায়নি। কিছু উদীয়মান রাজনীতিবিদ আছে বৈকি, কিন্তু তারা কতটা দলীয় সত্তাকে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছে, তা বলা কঠিন। যদিও বর্তমানে এমপি, মন্ত্রী হওয়াকেই কেউ কেউ নেতৃত্বের পরিচয় মনে করেন। কিন্তু বলিষ্ঠ নেতৃত্বের জন্য যেমন আস্থার দরকার, ততটা খুব বেশি কেউ প্রমাণ দিতে পারেননি।
খুব আশ্চর্যজনকভাবে, কিছু জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ, আওয়ামী লীগের গত তিনবারের শাসনামলে তাদের জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন; আবার কাউকে কাউকে নিয়ে বিতর্কিত খবর প্রকাশ হতেও দেখা গেছে। বিভিন্ন রাজনীতিবিদের প্রয়াণেও সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন বিরূপ মন্তব্য দেখা গেছে। কিন্তু, এদের মধ্যে ব্যতিক্রম ছিলেন নিশ্চয় আব্দুর রাজ্জাক, সৈয়দ আশরাফ, সাহারা খাতুন, সিলেটের প্রয়াত মেয়র বদর উদ্দিন কামরান। তাদের মৃত্যুতে, এদেশের মানুষ যে পরিমাণ শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন, তা বর্ণনাতীত। এমন ইতিবাচক গণঅনুভূতি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, এই নেতারা ছিলেন প্রকৃত রাজনীতিক। তারা আজীবন ত্যাগের রাজনীতি করেছিলেন। ভোগের রাজনীতি তাদের আবিষ্ট করতে পারেনি। ব্যক্তিগতভাবে বা দলীয়ভাবে তারা জনমানুষের জন্য কতটা কী করতে পেরেছিলেন, সে হিসাব মানুষ খুব মেলাতে যায়নি। মানুষ শুধু জেনেছে যে, তারা দুর্নীতিতে জড়াননি, আর বিতর্ক তাদের ছুঁতে পারেনি। শুধু এটুকু জেনেই এদেশের মানুষ যে অকৃত্রিম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা জানিয়েছে, তা অভূতপূর্ব। এগুলো দেখলে মনে হয়, এদেশের মানুষের রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে এখন আর তেমন কোনো চাহিদা নেই, এরা শুধু চায়, রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে আইনের শাসন আর জাতীয় সম্পদটুকু নিরাপদ থাকুক।
গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকারের নিরাপত্তা, ভোটের অধিকার, খাদ্যের নিরাপত্তা, ভোটের নিরাপত্তা, এসবের বাস্তবায়ন করতে যা দরকার তা হলো আলোকিত উদার রাজনৈতিক নেতৃত্ব। যে নেতৃত্ব বিভাজনের রাজনীতি পরিত্যাগ করে, উদার রাজনৈতিক চেতনার মাধ্যমে জাতি ও রাষ্ট্র গঠনে ভূমিকা রাখবে। যে নেতৃত্ব দুর্নীতিমুক্ত রাজনৈতিক বলয় সৃষ্টির মাধ্যমে আমলা বা রাষ্ট্রীয় নির্বাহীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করে, এমন গণতন্ত্র কায়েম করবে, যেখানে রাজনীতিকদের ভোটের পরিবেশ বা নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে চিন্তা না করতে হয়। দেশের এবং মানুষের জন্য কাজের যে আমলনামা, তাই তখন হবে নির্বাচনের একমাত্র নিরূপক। এই ব্যবস্থায়, সরকারী কর্মচারীদের প্রভাবিত করার প্রয়োজন হবে না। নির্বাচন কমিশনারদের নাম-পরিচয় নিয়ে মানুষকে মাথা ঘামাতে হবে না। প্রজেক্টের নামে রাজনীতিবিদদের আর আমলাদের অর্থ আত্মসাতের কোনো অসুস্থ জনব্যবস্থা থাকবে না। রাষ্ট্রের প্রতিটা পয়সার হিসাব যাবে জনগণের কাছে। জনগণ, রাজনৈতিক নেতাদের কাজের মূল্যায়ন করে, তাদের সংসদে পাঠাবে। এমন ধারা সৃষ্টি করতে পারলেই হবে, রাজনীতির সুষ্ঠু চর্চা। রাষ্ট্র খুঁজে পাবে সঠিক নেতৃত্ব। প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতিক দিয়ে বিভাজনের রাজনীতি করা সম্ভব বটে, কিন্তু তা দিয়ে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব নয় আদৌ।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বরাবরই ছিল জনমানুষের দল। তাই, এই দল অতি অল্প সময়ে জনপ্রিয় হয়েছিল এর সাম্যের আর গণতন্ত্রের মূলনীতির কারণে। কিন্তু, সেই ছন্দের কোথায় যেন ছেদ পড়েছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন এই দলের বিভিন্ন স্তরে যোগ্য নেতৃত্বের সংকট আছে বহুদিন থেকে। নেতা আসছে হু হু করে, কিন্তু নেতৃত্বে সংকট থেকেই যাচ্ছে। অল্প কয়েকজনের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এত বৃহৎ দল চালানো সম্ভব নয়। নেতৃত্বের বিকেন্দ্রীকরণ দরকার। ‘ভাই’ এর পরিবর্তে দরকার ‘নেতা’। এমন নেতা দরকার যে নেতার সম্পদের স্বচ্ছতা থাকবে। প্রাডো গাড়ি, বনানীর বাড়ি, আর দামি ঘড়ির নেতা হবেন না তিনি। নেতা হবে জনগণের এজেন্ট, কোনো করপোরেট এজেন্ট নয়। নেতার ব্যক্তিত্ব সরকারি আমলাদের সামনে নুয়ে পড়বে না। নেতার জীবন হবে দেশের জন্য
উৎসর্গীকৃত। নেতা মানুষের হৃদয়ের কথা পড়তে পারবেন। দেশের মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাজপথে আটকে রেখে নেতার গাড়ি হুস করে বেরিয়ে যাবে না। দেশের অসুস্থ মানুষকে সরকারি হাসপাতালের বারান্দায় ফেলে, আদর্শ নেতা জনগণের টাকায় উন্নত রাষ্ট্রের উন্নত চিকিৎসা নিতে যাবেন না। নেতার লাগবে না কোনো বৈষম্যমূলক ভিআইপি সুবিধা। নেতা জানবেন, জনগণই একমাত্র ভিআইপি; আর তারা সেবক মাত্র।
যোগ্য এবং জনপ্রিয় জাতীয় নেতা আজ আমাদের দরকার জরুরি ভিত্তিতে। যে নেতাদের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দেশ প্রকৃত টেকসই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হবে। যে দেশের হাতে, জনসম্পদ আর জনজীবন, দুই-ই নিরাপদ থাকবে। সরকারে থাকলে নেতৃত্বে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কিন্তু এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার বিকল্প নেই। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এমন নেতা তৈরি করুক যারা শুধু দলের কর্মীদের কাছে ‘ভাই’ হয়ে থাকবেন না; হবেন গণমানুষের নেতা। যে নেতাদের গায়ে দামি পারফিউমের গন্ধ থাকবে না, থাকবে মাটির সোঁদা গন্ধ। যে নেতৃত্ব থাকবে জনসম্পৃক্ত। জনগণের হাঁড়ির খবর তারা রাখবেন। জনগণের যে কোনো কষ্টে তাদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ হবে। দেশের মানুষের এমন নেতৃত্বের প্রত্যাশা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কাছেই বেশি। এই উপলব্ধির কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়